কোনো বল প্রয়োগ না করলে কী হয় সেটি আমরা জানতে পেরেছি নিউটনের প্রথম সূত্র থেকে। বল প্রয়োগ করলে কী হয় সেটা আমরা জেনেছি নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র থেকে। যখন একটি বস্তু অন্য বস্তুর ওপর বল প্রয়োগ করে তখন বস্তু দুটির মাঝে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়, সেটি আমরা জানতে পারব নিউটনের তৃতীয় সূত্র থেকে। সূত্রটি এ রকম:
নিউটনের তৃতীয় সূত্র: যখন একটি বস্তু অন্য একটি বস্তুর ওপর বল প্রয়োগ করে তখন সেই বস্তুটিও প্রথম বস্তুটির ওপর বিপরীত দিকে সমান বল প্রয়োগ করে।
পদার্থবিজ্ঞানের বইয়ে সাধারণত যেভাবে নিউটনের তৃতীয় সূত্র লেখা হয়, “প্রত্যেকটি ক্রিয়ার (action) একটা সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া (Reaction) থাকে”, আমরা এখানে সেভাবে লিখিনি। আমাদের এতক্ষণে যেহেতু বল সম্পর্কে খানিকটা ধারণা হয়েছে হঠাৎ করে বলকে “ক্রিয়া” কিংবা “প্রতিক্রিয়া” বললে বিভ্রান্তি হতে পারে! তার চেয়ে বড় কথা যারা নতুন পদার্থবিজ্ঞান শেখে তাদের প্রথম প্রশ্নই হয় যে যদি সকল ক্রিয়া (কোনো একটি বল) একটি বিপরীত প্রতিক্রিয়া (আরেকটি বল) থাকে তাহলে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া একে অপরকে কাটাকাটি করে শূন্য হয়ে যায় না কেন! এ জন্য তৃতীয় সূত্রটিতে খুব স্পষ্ট করে লিখে দেওয়া দরকার, তৃতীয় সূত্র বলছে যে যদি দুটি বস্তু A এবং B থাকে তাহলে A যখন B বলের ওপর বল প্রয়োগ করে তখন B বল প্রয়োগ করে A এর ওপর! বিপরীত দুটি বল ভিন্ন ভিন্ন বস্তুতে কাজ করে, কখনোই এক বস্তুতে নয়। যদি একই বস্তুতে দুটি বল প্রয়োগ করা হতো শুধু তাহলেই একে অন্যকে কাটাকাটি করতে পারত। এখানে কাটাকাটির কোনো সুযোগ নেই।
কয়েকটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। ধরা যাক ওপর থেকে আমরা m ভরের একটা বস্তু (আপেল) উপর থেকে ছেড়ে দিয়েছি । আমরা জানি পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ বলের জন্য m. ভর পৃথিবীর দিকে একটা বল F অনুভব করবে:
আমরা আগেই দেখেছি এই বলটাকে mg হিসেবে লেখা যায়।
নিউটনের তৃতীয় সূত্র শেখার পর আমরা জানি ভরটিও বিশাল পুরো পৃথিবীটাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করছো সেই বলটিও শুধু বিপরীত দিকে। আমরা এই বলটিকে নিয়ে মাথা ঘামাই না, তার কারণ এই বলটার কারণে পৃথিবীর কতটুকু ত্বরণ a হচ্ছে সেটা ইচ্ছে করলে বের করতে পারি:
এখানে M হচ্ছে পৃথিবীর ভর এবং a হচ্ছে পৃথিবীর ত্বরণ
কাজেই
যদি পৃথিবীর ভর M = kg হয় তাহলে আমরা যদি 1 kg ভরের একটা বস্তুর উপর থেকে ছেড়ে দিই তার জন্য পৃথিবীর ত্বরণ হবে
এটি এত ক্ষুদ্র যে কেউ এটা নিয়ে মাথা ঘামায় না! তুমি যখন পরেরবার কোনো জায়গায় লাফ দেবে তখন মনে রেখো নিচে পড়ার সময় পুরো পৃথিবীকে তুমি আকর্ষণ করে নিজের দিকে টেনে নিয়েছিলো (যত কমই হোক তুমি সারা পৃথিবীকে নিজের দিকে টেনেছিলে, সেটা নিয়ে একটু পর্ব করতে পারো।)
নিউটনের তৃতীয় সূত্র বোঝার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে আমরা কীভাবে হাঁটি সেটা বোঝা। আমরা সবাই হাঁটতে পারি এর পেছনে কী পদার্থবিজ্ঞান আছে সেটা না জেনেই সবাই হাঁটে। কিন্তু ভোমরা যেহেতু পদার্থবিজ্ঞান শিখতে শুরু করেছ তোমাদের খুব সহজ একটা প্রশ্ন করা যায়। তুমি যেহেতু স্থির অবস্থা থেকে হাঁটতে পারো, কাজেই আসলে তোমার একটি ত্বরণ হচ্ছে, যার অর্থ তোমার উপর বল প্রয়োগ করা হচ্ছে। কিন্তু আমরা সবাই জানি কেউ আমাদের উপর বল প্রয়োগ করে না। আমরা নিজেরাই হাঁটি। কেমন করে সেটা সম্ভব?
নিউটনের তৃতীয় সূত্র না জানা থাকলে আমরা কখনোই হাঁটার বিষয়টা ব্যাখ্যা করতে পারতাম না। আমরা যখন হাঁটি তখন আমরা পা দিয়ে মাটিতে ধাক্কা দিই (অর্থাৎ বল প্রয়োগ করি) তখন মাটিটা নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী আমাদের শরীরে সমান এবং বিপরীত বল প্রয়োগ করে । এই সমান এবং বিপরীত বলটা দিয়েই আমাদের ত্বরণ হয়, আমরা হাঁটি!
বিষয়টা যাদের বুঝতে একটু সমস্যা হচ্ছে তাদেরকে মনে করিয়ে দেওয়া যায়, শক্ত মাটিতে হাঁটা সোজা কিছু ঝুরঝুরে বালুর উপর হাঁটা সোজা না। তার কারণ বালুর ওপর বল প্রয়োগ করা যায় না, বালু সরে যায়। তাই নিউটনের তৃতীয় সূত্রের পাল্টা বলটাও ঠিকভাবে পাওয়া যায় না। ব্যাপারটা আরো অনেক স্পন্ট করে দেওয়া যায় যদি কাউকে অসম্ভব মসৃণ একটা মেঝেতে সাবান পানি কিংবা তেল দিয়ে পিচ্ছিল করে হাঁটতে দেওয়া হয়। সেখানে ঘর্ষণ খুব কম, তাই আমরা পেছনে বল প্রয়োগ করতেই পারব না এবং সে জন্য তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে আমাদের ওপর কোনো বলও পাব না। তাই হাঁটতেও পারব না (বিশ্বাস না হলে চেষ্টা করে দেখতে পারো)। বল প্রয়োগ করলে বিপরীত ব সমান বল পাওয়া যায়, যদি প্রয়োগ করতেই না পারি তাহলে তার প্রতিক্রিয়া বল পাব কেমন করে? আর হাঁটব কেমন করে?
আরও দেখুন...